এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই নেতার বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নতুন মাত্রায় পৌঁছেছে।
শেখ হাসিনা তার বিবৃতিতে আরও বলেন, ‘আজ ফ্রান্স ও বাংলাদেশের মধ্যে আমাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের একটি ঐতিহাসিক দিন, যা পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে বিকশিত হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী জানান, তিনি আজ অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে দ্বিপক্ষীয় সব বিষয়ে প্রেসিডেন্ট মাখোঁর সঙ্গে ফলপ্রসূ আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, ফ্রান্স বাংলাদেশের সার্বভৌম নীতি, স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রকাশ করেছে, বিশেষ করে চলমান ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার প্রেক্ষাপটে।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা উভয়েই আশা করি, বাংলাদেশ ও ফ্রান্সের মধ্যে এই নতুন কৌশলগত পদক্ষেপ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’ তিনি আরও বলেন, গত দেড় দশকে বাংলাদেশে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা, উন্নয়ন ও সুশাসনের ওপর ভিত্তি করে এই নতুন সম্পর্কের ভীত রচিত হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ফ্রান্স সরকার জনগণের মৌলিক ও মানবাধিকার রক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীল ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে।’
শেখ হাসিনা জানান, দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের অগ্রগতির লক্ষ্যে তারা বিশদ আলোচনা করেছেন এবং ‘আমরা কিছু ঐকমত্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছি।’
বাংলাদেশের বিশ্বস্ত উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘অবকাঠামো উন্নয়নে ফ্রান্স আমাদের অব্যাহত সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।’ তিনি বলেন, তারা বাংলাদেশের কৌশলগত নিরাপত্তা অবকাঠামো নির্মাণে উন্নত ও বিশেষায়িত প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদানে আগ্রহ দেখিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নেতৃস্থানীয় এবং দায়িত্বশীল আবাসিক শক্তি হিসেবে বাংলাদেশ ও ফ্রান্স এই অঞ্চলের ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে কাজ করবে।
সরকারপ্রধান উল্লেখ করেন, ‘আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় ফ্রান্সের নেতৃত্বকে স্বাগত জানাই এবং একটি টেকসই তহবিল গঠনের জন্য প্রেসিডেন্ট মাখোঁর আহ্বানের প্রশংসা করি।’
অন্যদিকে ব্রিফিংয়ে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ জানান, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে দেশটির সঙ্গে কাজ করতে চায় ফ্রান্স। সেই লক্ষ্যেই বিদ্যুৎ, স্যাটেলাইটসহ প্রযুক্তি খাতেও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক দুই দেশের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করবে।
ফরাসি এয়ারবাসের ওপর আস্থা রাখা এবং তাদের কাছ থেকে উড়োজাহাজ ও স্যাটেলাইট কেনার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি ধন্যবাদ জানান মাখোঁ।
মাখোঁ বলেন, ‘ইউরোপীয় অ্যারোনটিকসে আস্থা রাখার জন্য এবং ১০টি এ-৩৫২ নেয়ার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেয়ার জন্য আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই। উড়োজাহাজের দিক দিয়ে এয়ারবাস একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্র্যান্ড।’
ফরাসি সংবাদমাধ্যম এএফপি জানিয়েছে, ফ্রান্স তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলকে ‘শক্তিশালী’ করতে এবং এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বা ‘নতুন সাম্রাজ্যবাদ’ প্রতিরোধের লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশে সফর করছে।
দেশটি তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে।
এ নিয়ে মাখোঁ শেখ হাসিনাকে বলেন, ‘ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নতুন সাম্রাজ্যবাদের মুখোমুখি। এখন আমরা গণতান্ত্রিক নীতি এবং আইনের শাসনের ওপর ভিত্তি করে একটি তৃতীয় উপায় প্রস্তাব করতে চাই, যেখানে আমাদের কোনো অংশীদারকে খাটো করা হবে না বা তাদের একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়া হবে না।’
এএফপি বলছে, মূলত যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ইন্দো-প্যাসিফিকের বিস্তৃত অঞ্চলে প্রভাব খাটানোর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে এবং মাখোঁ ফ্রান্সকে একটি বিকল্প হিসেবে সামনে দাঁড় করাতে চাইছে।
মাখোঁ তার সফরে বাংলাদেশের প্রশংসা করে বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার এ দেশটি ‘অসাধারণ সাফল্য’ অর্জন করেছে, বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে তার স্থান ধীরে ধীরে পুনরুদ্ধার করছে।’
প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা বিশ্বের অষ্টম জনবহুল এই দেশটি তাদের অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল রেখেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এই প্রেক্ষাপটে ফ্রান্স বাংলাদেশের উন্নয়নের অংশীদার হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে যেসব খাতে ফ্রান্স শক্তিশালী, সেসব খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে অংশীদারত্ব চায় দেশটি।
মাখোঁ বলেন, ‘রাশিয়া যখন ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করতে যুদ্ধ পরিচালনা করছে, এই অবস্থায় আমাদের দায়িত্ব দীর্ঘস্থায়ী বন্ধুদের সঙ্গে অংশীদারত্ব গড়ে তোলা এবং টেকসই বিকল্প প্রস্তাব করা। আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে এই পথে চলতে চাই।’
এর আগে, সোমবার সকাল ১০টা ২০ মিনিটে ফরাসি প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পৌঁছলে শেখ হাসিনা টাইগার গেটে ফুলের তোড়া দিয়ে তাকে স্বাগত জানান। পরে দুই নেতা একান্ত বৈঠকে মিলিত হন।
দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের আগে শেখ হাসিনা ও ইমানুয়েল মাখোঁ একটি ফটোসেশনেও অংশ নেন।
দুই নেতার উপস্থিতিতে দুটি চুক্তিও সই হয়।
ভারতের নয়াদিল্লিতে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগদান শেষে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে গত রোববার রাতে ঢাকা আসেন মাখোঁ।
এটি ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁর প্রথম বাংলাদেশ সফর। এর আগে প্রথম ফরাসি প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফ্রাঁসোয়া মিতেরাঁ ১৯৯০ সালের ২০-২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ সফর করেন।
গতকাল সোমবার বিকেলে প্যারিসের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট।
ঢাকা-প্যারিস দুটি চুক্তি স্বাক্ষর
ঢাকা ও প্যারিস বঙ্গবন্ধু-২ স্যাটেলাইট এবং বাংলাদেশের নগর অবকাঠামো উন্নয়ন বিষয়ে দুটি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের (পিএমও) করবি হলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁর উপস্থিতিতে চুক্তিপত্র দুটি স্বাক্ষর করে বিনিময় করা হয়।
চুক্তি দুটির একটি হলো- ‘ইমপ্রুভিং আরবান গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রোগ্রাম’ বিষয়ে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) এবং ফ্রান্সের ফ্রান্স ডেভেলপমেন্ট সংস্থার (এএফডি) মধ্যে ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি অ্যাগ্রিমেন্ট এবং আরেকটি হচ্ছে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) ও বঙ্গবন্ধু-২ আর্থ অবজারভেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম-সম্পর্কিত ফ্রান্সের এয়ারবাস ডিফেন্স অ্যান্ড স্পেস এসএএসের মধ্যে সহযোগিতার বিষয়ে লেটার অব ইনটেন্ট (এলওআই) চুক্তি।
ইআরডি সচিব শরিফা খান ও এজেন্স ফ্রান্সেইস দো ডেভেলপমেন্টের (এএফডি) কান্ট্রি ডিরেক্টর বোনুই শসেত নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রথম চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেন। দ্বিতীয় চুক্তিটিতে স্বাক্ষর করেন বিএসসিএল চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ ও স্পেস সিস্টেম, এয়ারবাসের সেলস ও মার্কেটিং বিভাগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট স্টিফেন ভেসভাল।